যুগান্তর রিপোর্ট ২৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
রাজধানীর রামপুরায় ইজি গার্মেন্টসের মালিকপক্ষের লোকজনের বেদম পিটুনিতে শ্রমিক দেলোয়ার হোসেন ওরফে সাঈদী নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা করতে গিয়ে স্বজনরা পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নানা কথা বলে মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ গড়িমসি করে। এছাড়া মামলা না করে ভিকটিমের পরিবারকে আপস-মীমাংসায় যেতে বলছে প্রভাবশালী মহল। নিহতের মামা অ্যাডভোকেট আবু তাহের ভূইয়া এ অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, মামলা রেকর্ড করতে গড়িমসি করায় সর্বশেষ লাশ থানার সামনে রেখে বিক্ষোভের হুমকি দিলে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পর মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। তবে পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জানতে চাইলে মামলার বাদী ও ভিকটিমের মামা অ্যাডভোকেট আবু তাহের ভূইয়া যুগান্তরকে বলেন, ইজি গার্মেন্টস অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের টাকার অভাব নেই। তারা চাচ্ছে যাতে মামলা মোকদ্দমা না করি। যাতে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হয়। তিনি বলেন, আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যা হওয়ার তাতো হয়েছে, এখনতো আর ভিকটিমকে ফিরে পাবেন না। আপনারা দেখেন চিন্তাভাবনা করে, কী করা যায়। একটা পর্যায়ে আমাদের মীমাংসা করে নিতে বলা হয়।
তিনি আরও বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় থানায় ডেকে নিলেও মামলা রেকর্ড করে বেলা ৩টায়। অথচ মামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বুধবার রাত ২টায়। পুলিশ মামলা নিতে চাচ্ছিল না, একপর্যায়ে আমরা রাগারাগি শুরু করলে মামলা রেকর্ড করে। মামলা করতে গিয়ে আমাকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আমরা চাই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। আমাদের টাকার প্রয়োজন নেই।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই শাকিল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ইজি গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জেনারেল ম্যানেজারসহ এজাহার নামীয় ৯ জন এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেফতার তিনজনকে আদালতে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় শুক্রবারও থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে রামপুরার হাজীপাড়া এলাকা। এই এলাকায়ই ইজি গার্মেন্টস অবস্থিত। সব ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়। এ ছাড়া বন্ধ রাখা হয়েছে গার্মেন্টসটির সবক’টি বিভাগ। গার্মেন্টস কর্মী দেলোয়ারকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ সহকর্মীরা শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা মেডিকেল ও হাতিরঝিল থানা এলাকায় অবস্থান নেন। রেহানা খাতুন নামে এক সহকর্মী বলেন, বুধবারও আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছি। সে আমাদের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সুতা সরবরাহ করত। ওই দিন আমার সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার দেলোয়ার ও তার আরও তিন বন্ধু মিলে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। দেলোয়ার বিমানের টিকিটও কেটে ছিল। কিন্তু তার আর যাওয়া হল না। ভিকটিমের আরেক সহকর্মী আমানুল্লা বলেন, ‘গার্মেন্টসে কমবেশী চুরি হয়। ইতিপূর্বেও হয়েছে। সেখানে আমরা দেখেছি চড়-থাপ্পড় দিয়ে বের করে দিতে। কিন্তু কেন এভাবে হত্যা করা হল?
নিহতের চাচা মনির হোসেন বলেন, ‘আমরা স্বজনহারা হয়েছি, একটি মাত্র আশার প্রদীপ ছিল, সেটাও নিভে গেল। তার বাবা-মা কিভাবে বেঁচে থাকবে? দেলোয়ার যদি অপরাধ করে তাহলে দেশের আইন আছে, বিচার আছে। তাকে পুলিশে দিতে পারত। সামান্য একটি চুরির অপবাদ দিয়ে একজন মানুষকে মেরে ফেলা যায় না। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
স্বজনদের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার আনিসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে এমন কিছুই বলা হয়নি। তারা যেভাবে মামলার এজাহার দিয়েছে সেভাবেই রেকর্ড করা হয়েছে। এজাহারে কার নাম আছে কার নেই সেটাও দেখা হয়নি। এ ঘটনায় পুলিশের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সেবা দেয়ার। যারা এ কথা বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে।
দাফন সম্পন্ন : পোস্টমর্টেম শেষে শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনদের কাছে দেলোয়ারের লাশ হস্তান্তর করা হয়। অ্যাম্বুলেন্সে লাশ চাঁদপুর জেলার কচুয়ায় তার গ্রামের বাড়িতে নেয়া হলে সেখানে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একমাত্র ছেলে সন্তানের লাশের ওপর পড়ে বাবা-মা বিলাপ করতে থাকেন। পরে রাতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। দেলোয়ারের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানায়। তার বাবার নাম মো. মোশাররফ হোসেন।
প্রতিবাদে শ্রমিকদের বিক্ষোভ : দেলোয়ারকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে বিক্ষোভ সমাবেশ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তারা বলেন, একজন শ্রমিক নিজ কারখানার ভেতরে খুন হলে সেটা কিভাবে ‘গণপিটুনির’ হয়! আর এ কথা কিভাবে দেশের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম প্রচার করে!
তারা বলেন, মালিক কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারাই সমাজে কিছুটা ক্ষমতাধর তারা মানুষকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করছেন না। তারা আবার গল্প সাজিয়ে হত্যার অপরাধ থেকে দায়মুক্তিও পেয়ে যাচ্ছে।
শ্রমিক নেতারা বলেন, এখনই ইজি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেফতার করতে হবে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেসিকের সমান ঈদ বোনাস ও জুলাই মাসের মজুরিসহ সকল বকেয়া আগামী ৪ আগস্টের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
সমাবেশে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন।