উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজন শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্য


নিউজ আপলোড : ঢাকা , শনিবার, ১০ অক্টোবর ২০২০
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা সহায়তা ও সহযোগিতা না পেলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতায় প্রভাব পড়ে। তাই কর্মক্ষেত্রে এবং পরিবারে মানসিক স্বাস্থের বিষয়টিতে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২০ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস্ ও সাজেদা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এবং অ্যাম্বেসী অব দ্যা কিংডম অব দ্যা নেদারল্যান্ডস ও এসএনভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ওয়ার্কিং উইথ উইমেন-টু প্রজেক্ট) এর সহযোগিতায় ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য : বিনিয়োগ করুন’ শীর্ষক সেমিনারে শনিবার (১০ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে বক্তারা এ মন্তব্য করেন।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গুরুত্বারোপ ও প্রয়োজনীয়তা, সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রসহ সব পর্যায়ে এর প্রচার ও প্রসার বিষয়ে সুপারিশমালা প্রণয়নসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের দায়িত্ব আলোচনা করার উদ্দেশ্যে এই সেমিনার এর আয়োজন করা হয়।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে শ্রমশক্তিতে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে সাজিদা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ম্যানেজার ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলোজিস্ট রুবিনা জাহান বলেন, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা সহায়তা ও সহযোগিতা না পেলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতায় প্রভাব পড়ে। দেশের ১৭ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের কোন না কোন রকম মানসিক সমস্যা রয়েছে। এর পরিমাণ নারীদের মধ্যে বেশি। ৯২ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভোগে, যার কোন চিকিৎসা সাধারণত তারা নেয় না। অবসাদের মতো মানসিক সমস্যা বেশি হয় শারীরিক অক্ষমতা ও চাকরিহীনতায়। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি একটি সাধারণ এবং ক্রমবর্ধমান বিষয় উল্লেখ তিনি আরও বলেন, আমাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী যে পরিমাণ সার্ভিস প্রোভাইডার দরকার, তার কমতি আছে। কিন্তু ক্লিনিক্যাল ও মেন্টাল ডিজঅর্ডার হলেই কিন্তু শুধুমাত্র সাইকিয়েট্রিস দরকার। আমাদের প্যারাকাউন্সেল তৈরি করতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইলে প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা সম্পন্ন জনবল বাড়াতে হবে। এছাড়াও সব পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং মেন্টাল হেলথ ইস্যুতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ইনভেস্টমেন্টে উৎসাহিত করতে হবে।

উদ্বোধনী বক্তব্যে বিলসের মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম খান বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য শুধু শ্রমজীবী মানুষের জন্যই নয় সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত শ্রমজীবী মানুষেরা নানাবিধ মানসিক সমস্যায় থাকেন। আমাদের দেশের শ্রম আইনে পেশাগত রোগ বিষয়টি উল্লেখ আছে, কাজ করতে গিয়ে শ্রমজীবীরা যেসব রোগে আক্রান্ত হন, তার তালিকায় অনেক রোগের উল্লেখ আছে। শ্রমিকরা যে পরিবেশে কাজ করে এবং বাস করে তাতে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ও সহকর্মীদের দুর্বব্যহার, যৌন নিপীড়ন, কুঅভ্যাস ইত্যাদি দমন না করা হলে সেটিও তার মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। সম্মিলিত উদ্যোগে এ সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব।

নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তৌহিদা শিপ্রা বলেন, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থের বিষয়টিতে মনোযোগী হওয়ার এখনই সময়। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, হতাশা ইত্যাদি এগুলো মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এজন্য কর্মক্ষেত্র আরও বেশি মানসিক স্বাস্থ্য বান্ধব হওয়া প্রয়োজন। তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি রিক্রিয়েশনের মাধ্যমে সবাইকে জানানো যেতে পারে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ের সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য সব পর্যায় থেকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার।

ইনোভেশন ফর ওয়েলবিইং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিডার মনিরা রহমান বলেন, মানসিক সমস্যা শুধুমাত্র ডক্টর বা সাইক্রিয়েটিস্ট ট্রিটমেন্ট করবে তাই নয়, একটি মাল্টি স্টেকহোল্ডার এপ্রোচ দরকার। যে সমস্যাটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, যা শুধুমাত্র লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করলেই সম্ভব, এটা প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করে উদ্যোগ নেয়া দরকার। মানসিক সমস্যা হলে আমরা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, সামাজিক স্টিগমা এর কারনে। গ্লোবাল ডাটা বলছে প্রতি ৪ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভোগে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েনি তার বাইরে কেউই নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু শ্রমিক নয়, ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা থাকেন তারাও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা সমাধানে পিয়ার সাপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট পলিসি নেই, একটি মাত্র অ্যাক্ট আছে, যা সম্প্রতি হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মেন্টাল হেলথ ফাস্ট এইড বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করা যায়।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের দেশে একটি নীতিমালা আছে, যা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন উল্লেখ করে বিশেষ অতিথীর বক্তব্যে বিজিএমইএ এর হেলথ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হানিফুর রহমান লোটাস বলেন, যারা তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম সারির স্ট্যান্ডার্ড পোশাক তৈরি করেন, সেই শ্রমজীবীরা বেশিরভাই থাকেন বস্তিতে এবং তাদের বেশিরভাগেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। শুধু মেশিনের সঙ্গেই নয়, শ্রমিককে পরিবারের সঙ্গে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, যাওয়া-আসার পথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হয়। এক্ষেত্রে মালিকরা নিজস্ব দায়বোধ থেকে শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা সমাধানে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিজিএমইএ টেলিমেডিসিন নিয়েও কাজ করছে, যার মাধ্যমে শ্রমিককের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাউন্সিলিং করানো হয়। এছাড়াও শ্রমিকের পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে বিজেএমইএ আগে থেকেই কাজ করছে। উৎপাদনশীলতায় এর গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকের স্বাস্থ্যে ১ টাকা বিনিয়োগ করলে উৎপাদনশীলতায় ১৫-১৭ টাকা রিটার্ন পাওয়া যাবে। এটি নিয়ে ভবিষ্যতে আর কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

ফকির অ্যাপারেলস লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (এইচআরএসি) মনজুরুল করিম বলেন, আমি এসএনভি’র সহযোগিতায় ইউসেপ বাংলাদেশ ও সাজিদা ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে ‘ওয়ার্কপ্লেস ওয়েলবিইং মেনেজম্যান্ট’ বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা দেখেছি, নারী শ্রমিক তার পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তায় থাকে। তাই পরিবারের দুশ্চিন্তা তাদের কর্মক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। ফকির অ্যাপারেলস লিমিটেডের মানসিক পরামর্শ কর্নার করা হয়েছে, প্রতিদিন ৪/৫ জন শ্রমিক সেখান থেকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে থাকেন।

আমরা নিয়মিতভাবে শ্রমিকদের কাউন্সিলিং করছি। যার ফলে কর্মস্থলে শ্রমিকের অনুপস্থিতির হার কমছে। এ ধরনের ভালো উদ্যোগগুলো শুধু ফকির অ্যাপারেলরস এই না, অন্যান্য কারখানাগুলোতোও শুরু করা দরকার। ছোট বা বড় নয়, সব কর্মক্ষেত্রেই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

সমাপনী বক্তব্যে এসএনভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এর ইনক্লুসিভ বিজনেস এডভাইজার জামাল উদ্দিন বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য শুধু শ্রমিক বা মালিকের ইস্যু না, এটি জাতীয় ইস্যু। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি শারীরিক স্বাস্থ্যের তুলনায় কম গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সম্মিলিত উদ্যোগে ও গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।