আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের প্রতিবেদন : শ্রম অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভারের কর্ণপাড়ার আনলিমা টেক্সটাইলের কর্মী সুমন মিয়া মারা যান গত জানুয়ারিতে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক ইউনিয়ন কনফেডারেশন বলছে, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ হারান তিনি। ওই আন্দোলনে অর্ধশত শ্রমিক আহতও হন।
এর আগে গত বছর ঢাকার আশিয়ানা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া ১২ শ্রমিক নেতা ও সদস্যের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ আনে মালিকপক্ষ। যদিও ওই ১২ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এসব তথ্য তুলে ধরে আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন বলছে, শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই যেসব দেশে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ১৪৫টি দেশে শ্রম অধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর ‘২০১৯ আইটিইউসি গ্লোবাল রাইটস ইনডেক্স: ওর্স্ট কান্ট্রিজ ফর ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বিশ্বে ট্রেড ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় এ ফেডারেশনটি। ব্রাসেলভিত্তিক সংগঠনটির প্রতিবেদনে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের মতো ২০১৯ সালেও শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকা দেশের তালিকায় জায়গা হয়েছে বাংলাদেশের।
ছয়টি বিষয়ে ১ থেকে ৫ ও তদূর্ধ্ব রেটিংয়ের ভিত্তিতে ইনডেক্সটি তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ইউনিয়ন কনফেডারেশন। আইনের শাসন ভেঙে পড়ায় শ্রম অধিকারের কোনো স্বীকৃতি নেই এমন দেশগুলোকে রাখা হয়েছে ৫ বা তদূর্ধ্ব রেটিংয়ের তালিকায়। রেটিং ৫-এ থাকা দেশগুলোয় শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই। রেটিং ৪-এর আওতায় থাকা দেশগুলোয় পরিকল্পিতভাবে অধিকার লঙ্ঘন হয়। রেটিং ৩ প্রাপ্ত দেশগুলোয় অধিকার লঙ্ঘন নিয়মিতভাবেই হয়। রেটিং ২ পাওয়া দেশগুলোয় অধিকার লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি হয়। রেটিং ১ প্রাপ্ত দেশগুলোয় বিক্ষিপ্তভাবে অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।
রেটিং ৫ প্রাপ্ত শ্রমিক অধিকারের কোনো স্বীকৃতি নেই এমন ৩৪টি দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ। আইটিইউসির প্রতিবেদনটির প্রারম্ভিক বক্তব্যেই শ্রমিকের জন্য নিকৃষ্টতম দেশগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ২০১৯ সালে শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে আলজেরিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, কাজাখস্তান, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, তুরস্ক ও জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশকে বিবেচনার ক্ষেত্রে নৃশংসতা, গণহারে চাকরিচ্যুতি ও ইউনিয়ন নেতাদের গ্রেফতারের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, এমন দেশও আছে যেখানে শ্রমিকের জীবন কোনো মানবিক বিবেচনায় নেয়া হয় না। উদাহরণস্বরূপ ২০১৮ সালে কলম্বোয় ৩৪ জনকে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলোমেলোভাবে দুটি কোম্পানির নাম উল্লেখ কোনোভাবেই অভিযোগ প্রমাণ করে না। ২০১৯ সালে একজন শ্রমিকের হত্যার বিষয়টি বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। যদিও আরো বেশি নৃশংসতার তথ্য প্রতিবেদনপ্রণেতা দিয়েছেন।
গণহারে ছাঁটাইয়ের প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, তদন্তের জন্য শ্রমিক ও বিজিএমইএ প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আট সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেহেতু আমরা সঠিক সংখ্যা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী, তাই কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে যেটা সঠিক তার পক্ষেই অবস্থান নেবে বিজিএমইএ।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক ইউনিয়ন কনফেডারেশন তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৮ সালে শুধু কলম্বোয় ৩৪ জন ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।
সারা বছর হত্যা করা হয়েছে মোট ৫৩ জন ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যকে। এছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য হত্যা করা হয়েছে এমন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, ইতালি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও জিম্বাবুয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। হিংস্রতার শিকার হয়েছেন মোট ৫২টি দেশের শ্রমিকরা।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী ধর্মঘট দমনের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বাংলাদেশের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শক্ত হাতে ধর্মঘট দমন ও শাস্তি দেয়া হয়েছে এমন দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ। কম্বোডিয়া, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডও এ তালিকায়। আবার বেশকিছু দেশে ইউনিয়ন কার্যক্রমে বাধা দেয়ার মতো পদক্ষেপ বারবার নেয়া হয়েছে এবং ইউনিয়নে আগ্রহী শ্রমিককে সুশৃঙ্খলভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমন দেশের উদাহরণ হিসেবেও বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছে ফেডারেশন।
প্রতিবেদনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে শ্রম অধিকার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের ঘটনা বিস্তারিত এসেছে। বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে এমন কারখানাগুলোর সাত হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে প্রতিবাদ করায় কাজ না থাকার ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বণিক বার্তাকে বলেন, নির্যাতন, শ্রমিক অধিকার, মজুরি এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে বাংলাদেশ নিকৃষ্টতম দেশের মধ্যে অন্যতম এমনটা আমার মনে হয় না। বিশ্বব্যাপীই শ্রমিকরা খুব চাপের মধ্যে আছেন, আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তবে প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে মারা গেছেন তা তারা যথাযথভাবে যাচাই করেছে কি? শ্রমিক চাকরিচ্যুত হওয়ার সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংখ্যাও প্রতিবেদনে ঠিকভাবে আসেনি। শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে এটা ঠিক, আবার একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটাও ঠিক।