টিবিএস ডেস্ক
09 October, 2020, 07:00 pm
ডব্লিউআরসি পরিচালক এবং নিবন্ধের সহ-লেখক স্কট নোভা বলেন, ‘‘আর্থিক মূল্য পরিশোধের অন্যায্য ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো আসলে উন্নয়নশীল দেশের সরবরাহকদের শোষণ করছে। মহামারির মধ্যে তাদের কার্যকালাপকে শুধু ডাকাতির সঙ্গেই তুলনা করা যায়।’’
বাংলাদেশে ১০ লাখ শ্রমিককে বাধ্যতামূলক ছুটি বা সম্পূর্ণ ছাঁটাই করা হয়েছে, বলে জানায় মার্কিন অধিকার গোষ্ঠী সিজিডব্লিউআর। ছবি: শিনহুয়া/ শাটারস্টক
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বড় ফ্যাশন কোম্পানিগুলো তাদের বিদেশি সরবরাহকদের ১৬শ’ কোটি ডলার পাওনা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারির পর থেকে এপর্যন্ত বিশাল অংকের এ পণ্যমূল্য দিতে চাইছে না তারা।
বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের নানা দেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা যেকারণে চরম ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছেন। পাশাপাশি কারখানা বন্ধের ঝুঁকিতে বেকার হয়ে পড়তে পারেন লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক। মহামারির মধ্যে যা মানবিক সঙ্কটকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলবে, বলে সাম্প্রতিক এক আমদানি তথ্যের বিশ্লেষণ সূত্রে জানা গেছে।
বিশ্লেষণটি করে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক দুটি অধিকার গোষ্ঠী; সেন্টার ফর গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটস (সিজিডব্লিউআর) এবং ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম (ডব্লিউআরসি)।
ইতোপূর্বে অপ্রকাশিত নানা দেশের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা জানায়, গত এপ্রিল থেকে জুন নাগাদ বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানিকারক এবং কারখানাগুলো ১,৬২০ কোটি ডলার আয় হারিয়েছে। এসময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ডগুলো আগের ক্রয়াদেশ বাতিল এবং ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে যাওয়া পোশাকের মূল্য পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করে। করোনাভাইরাস অতিমারি ধারণ করার আগেই এসব ক্রয়াদেশ দিয়েছিল তারা।
প্রতিবেদনটি জানায়, এসব কারণে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া এবং মিয়ানমারের মতো দেশের সরবরাহকদের বাধ্য হয়েই তাদের উৎপাদন কাজ সীমিত করতে হয়েছে। ফলে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ শ্রমিক। আর যারা বেকার হননি- তাদের কর্মঘণ্টাও কমিয়ে দিয়েছেন মালিকেরা।
ডব্লিউআরসি পরিচালক এবং নিবন্ধের সহ-লেখক স্কট নোভা বলেন, ”আর্থিক মূল্য পরিশোধের অন্যায্য ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো আসলে উন্নয়নশীল দেশের সরবরাহকদের শোষণ করছে। মহামারির মধ্যে তাদের কার্যকালাপকে শুধু ডাকাতির সঙ্গেই তুলনা করা যায়।”
নিবন্ধটি আরও জানায়, মহামারি ফ্যাশন শিল্পের প্রাণকেন্দ্রে ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণের অসম ব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচন করেছে।
ব্রান্ডগুলোর হাতে অঢেল ক্ষমতা। তারা গরিব দেশের সরবরাহকারকদের সম্পূর্ণ উৎপাদন খরচ বহনে বাধ্য করে। এরপরও, ক্রেতা হিসেবে তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস পণ্যের চালান কারখানা থেকে জাহাজিকরণ করার পরও, মূল্য পরিশোধে দেরি করে।
অথচ নিজেদের ব্যবসায়িক লাভটা ঠিকই ধরে রাখছে রিটেইলার ব্রান্ডগুলো। সরবরাহকারক এবং কারখানাগুলোকে বিপর্যয়ের মধ্যে রেখেই তারা শেয়ারহোল্ডারদের কোটি কোটি ডলার লভ্যাংশ দিয়েছে।
যেমন; গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল জায়ান্ট কোহল’ তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার লভ্যাংশ দেয়। বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশের কারখানায় দেওয়া কার্যাদেশ বাতিল করার এক সপ্তাহ পরই তারা এ লভ্যাংশ দিয়েছে।
ইতোপূর্বে, গত এপ্রিলে প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে কম্বোডিয়ার পোশাক উৎপাদনকারীদের জোট বিদেশি ক্রেতাদের প্রতি তাদের পূর্বের ক্রয়চুক্তিগুলো মেনে চলার আহ্বান জানায়। শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রায় সাড়ে ৭ লাখ কম্বোডিয় শ্রমিকের জীবিকা রক্ষার কথা উল্লেখ করে তারা এ অনুরোধ করেছিল।
চিঠিতে বলা হয়, ”কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব তৈরি পোশাকের বিশ্ব বাণিজ্যে জড়িত সকল পক্ষই অনুভব করছে। কিন্তু, আমরা উৎপাদকেরা অনেক কম মুনাফা হারের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করি। ক্রেতাদের তুলনায় তাই উৎপাদকদের মহামারির ভার বহনের আর্থিক সঙ্গতি অনেক কম। এর প্রভাব পড়বে আমাদের শ্রমিকদের উপর, যাদের উপর রয়েছে পরিবারের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব। কারখানা মালিকদের আর্থিক সঙ্কট তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।”
বাংলাদেশের একটি তৈরি পোশাক কারখানার গুদামে রাখা কার্যাদেশ বাতিলের আগেই উৎপাদিত তৈরি পোশাকের চালান। ছবি: নূর আলম/ দ্য গার্ডিয়ান
গবেষণায় জড়িত আরেক অধিকার গোষ্ঠী সিজিডব্লিউআর জানায়, ক্রেতাদের মূল্য পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে- বাংলাদেশের মতো দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশে ১০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিককে সাময়িক ভাবে ছুটি বা চিরতরে ছাঁটাই করা হয়েছে।
এর আগে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পোশাক শিল্পের কর্মীদের ছাঁটাইয়ের হাত থেকে বাঁচাতে ৫ হাজার কোটি টাকার জরুরি প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়। তারপরও, গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিকই কমপক্ষে দুই-তিন মাসের বেতন পাননি।
সিজিডব্লিউআর পরিচালক এবং গবেষণা নিবন্ধের মূল লেখক প্রফেসর মার্ক আন্নের অবশ্য স্বীকার করেন যে, করোনার কারণে পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো কিছুটা হলেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তবে এরপরও তারা আর্থিকমূল্য পরিশোধের দায় এড়াতে পারে না।
”সরবরাহ চক্রের শীর্ষে থাকায় তারা সম্পূর্ণ শিল্পকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। সে সুযোগ নিয়েই ব্রান্ডগুলো সঙ্কটের সময়ে সরবরাহকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ, ব্যবসার নৈতিকতা অনুসারে সরবরাহ চক্রের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা অংশকে রক্ষা করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের। পোশাক উৎপাদন শিল্পের শ্রমিকেরা সবচেয়ে ক্ষমতাহীন। তাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায় বড় ক্রেতারা এড়াতে পারে না,” তিনি যোগ করেন।
এ অবস্থায় বৃহৎ ব্র্যান্ড এবং রিটেইলারদের জবাবদিহির সম্মুখীন করার উদ্যোগ নিয়েছে সিজিডব্লিউআর এবং ডব্লিউআরসি। বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রয়চুক্তি মেনে চলছে কিনা- সে বিষয়ে নজর রাখতে তারা একটি কোভিড-১৯ ট্র্যাকার চালু করেছে।
নোভা নামক ওই ট্র্যাকার অনুসারে; টপশপ ব্রান্ডের মালিকানা প্রতিষ্ঠান আর্কেডিয়া গ্রুপ, ওয়ালমার্ট, আরবান আউটফিটার্স এবং মাদারকেয়ার- এর মতো বড় ক্রেতারা এখনও তাদের কাছে সরবরাহকদের পাওনা পরিশোধের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
এর বিপরীতে গ্যাপ, এইচঅ্যান্ড এম এবং জারার মতো বৃহৎ ক্রেতারা তাদের আগের অবস্থান বদলে সরবরাহদের আর্থিকমূল্য পরিশোধ করা শুরু করেছে। তবে শ্রমিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার পরই তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়।