বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ক অগ্রগতির পর্যালোচনা
২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল ৮:৪৫ এ সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। এ দূর্ঘটনায় এক হাজার ১১৩৬ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ভবনটিতে পোশাক কারখানা, একটি ব্যাংক এবং একাধিক অন্যান্য দোকান ছিল, সকালে ব্যস্ত সময়ে এই ধসের ঘটনাটি ঘটে। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্কবার্তা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। এর মাত্র পাঁচ মাস আগে ঢাকা পোশাক কারখানায় একটি বড় অগ্নিকান্ডের পর এই দুর্ঘটনাটি হয়, যেটি বাংলাদেশে ঘটা সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল দুর্ঘটনা।
গার্মেন্টস কারখানায় প্রায় ৫০০০ এর মত কর্মী কাজ করত। ২০০৭ সালে রানা প্লাজা নির্মাণ করার আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত ডোবা। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে এটি ভরাট করা হয়। ভবনের উপরের চার তলা অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছিল।
রানা প্লাজা ধসের কারণ হিসাবে নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ, নিচু মানের সামগ্রী ব্যবহারই প্রধান কারণ। এছাড়াও ভবনের নি¤œমানের পিলার, ফ্লোরে জেনারেটর স্থাপন, বয়লার আর ভারী মেশিন বসানো, অতিরিক্ত কাঁচামাল আর ধারণ ক্ষমতার বেশি কর্মী থাকাও ভবন ধসের কারণ ।
এর আগে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক নিহত হন। এসব ঘটনায় কারখানা ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ জন্য বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আংশিক দায়ী করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা ওঠে, বাংলাদেশ থেকে স্বল্প মজুরিতে তৈরি পোশাক কিনলেও শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অভিযোগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাসে নানা উদ্যোগ নেয়। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি চুক্তি হয়।
বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) সঙ্গে নিয়ে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় সব চুক্তি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। বিশ্বব্যাপী ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ তৈরি করতে থাকে ভোক্তা ও শ্রমিক সংঘ। ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোও একাট্টা হয়। বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনায় গঠিত হয় ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’ নামে ওয়ালমার্টসহ উত্তর আমেরিকার পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি জোট। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর খ্যাতনামা ব্র্যান্ড, শ্রমিক স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মিলে গঠন করে ‘দি অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ নামে আরেকটি জোট। ইউরোপ ও আইএলওর সঙ্গে সম্পন্ন হয় বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা চুক্তি ‘কমপ্যাক্ট’।
রানা প্লাজা পরবর্তী সময়ে সরকার ও বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের বহুমুখী উদ্যোগে পোশাক খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইনি ও ভৌত অবকাঠামো এবং শ্রম কর্মপরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় পোশাক খাতে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে গর্ব করার মতো জায়গায় এসেছে বাংলাদেশ। প্রায় ২৮টি কারখানা আছে; যারা ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) পরিবেশগত মানের সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে লিড সনদের সর্বোচ্চ মান প্লাটিনাম ছয়টি, গোল্ড ১৪টি, সিলভার পাঁচটি এবং তিনটি সার্টিফায়েড লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে একটি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। এ কারখানা ১১০ নাম্বারের মধ্যে ৯০ নাম্বার পেয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো কারখানা এত বেশি নাম্বার পাওয়ার ঘটনা বিরল। এ ছাড়া শতাধিক গ্রিন কারখানার ইউএসজিবিসি সনদ রয়েছে। ইউরোপীয় বায়ারদের জোট অ্যাকর্ড ও মার্কিন বায়ারদের জোট অ্যালায়েন্স কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রায় শতভাগ কারখানায় জরিপ সম্পন্ন করেছে এবং জরিপ পরবর্তী রেমেডিয়েশনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশের টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে উত্তর আমেরিকার পোশাক ক্রেতা ও সংস্থার জোট ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’। এই জোটে আছে ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, মেসি, ভিএফ, টার্গেট, জে সি পেনি, হাডসন বে, চিলড্রেনস প্লেস, কানাডিয়ান টায়ার করপোরেশন, এল এল বিনের মতো ২২টি নামি প্রতিষ্ঠান।
অপরদিকে অ্যাকর্ডের নতুন চুক্তিতে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে ভবন, অগ্নি এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা আছে। অ্যাকর্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধসে প্রায় এগারোশো শ্রমিকের মৃত্যুর পর এর আগে ২০১৩ সালে যে চুক্তি হয়েছিল, নতুন চুক্তিতে তার বাইরে আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগের চুক্তির মতো নতুন চুক্তিতেও বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে ভবন, অগ্নি এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আরও অনেক বিষয়। যার মধ্যে আছে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণের মতো বিষয়।
রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর কাজের পরিবেশ নিয়ে ২০১৩ সালে একটি চুক্তি করেছিল ইউরোপের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। অ্যাকর্ডের পক্ষ থেকে যে নতুন চুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সেটি কার্যকর এবছর থেকে, পুরনো চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর। বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে এরকম চুক্তিকে অভূতপূর্ব বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। কারণ যেসব ফ্যাশন ব্র্যান্ড এই চুক্তিতে সই করবে, তারা এটি আইনত মেনে চলতে বাধ্য।
”এই চুক্তিতে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যাতে তারা সত্যিকারের মজুরি পান এবং তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এসব অধিকার যেন মালিকরা মেনে চলে সেটা নিশ্চিত করার জন্য অ্যাকর্ড প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং কারখানা পরিদর্শনেরও ব্যবস্থা রাখবে,” বলেন অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং এন্ড ফায়ার সেফটির ওরিস ওলডেনযিয়েল। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের পুরো স্বীকৃতি অনেক জায়গাতেই নেই। নতুন চুক্তিতে যে সংগঠিত হওয়ার অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, তার মানে কি ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি? মিঃ ওলডেনযিয়েল বলছেন এর মানে হচ্ছে শ্রমিকদের সংগঠিত হবার অধিকারের যে গুরুত্ব তার স্বীকৃতি। বিশেষ করে শ্রমিকরা যেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কথা তুলে ধরতে পারেন। তিনি আরও বলছেন, অ্যাকর্ড চুক্তির অধীনে শ্রমিকরা এখন তাদের সংগঠনের অধিকারের বিষয়েও অভিযোগ তুলতে পারবেন।
অ্যাকর্ড বলছে, এ পর্যন্ত অন্তত পনেরটি নামকরা ফ্যাশন ব্র্যান্ড এই চুক্তিতে সই করেছে, যাদের মধ্যে রয়েছে যারা, অলডি, প্রাইমার্কের মতো ব্রান্ড। আরও অনেকে এতে সই করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নতুন এই চুক্তি কারখানা মালিকরা মেনে চলছে কীনা সেজন্যে পরিদর্শন এবং তদারকিরও ব্যবস্থাও রয়েছে । অ্যাকর্ড আরও জানিয়েছে, প্রায় এক হাজার কারখানা এই চুক্তির আওতায় রয়েছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশি কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত জোট হয়েছে অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ। এসব ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে এমন এক হাজার ৬০০ কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে এখন সংস্কার কাজ তদারকি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বছরের জুনের পর তাদের কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে এ কার্যক্রম আরও তিন বছর বাড়ানোর বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।