ন্যূনতম মজুরি ৮০০০, শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রত্যাখ্যান

কালের কণ্ঠ অনলাইন

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৫:২৯দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছে সরকার। আগের মজুরি থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকা বাড়িয়ে নতুন ন্যূনতম মজুরি করা হয়েছে আট হাজার টাকা। আগামী ডিসেম্বর থেকে এই মজুরি কার্যকর হবে। আগে এই মজুরি ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। অন্যদিকে ন্যূনতম এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে পোশাক শিল্পের শ্রমিক সংগঠনগুলো। ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকার দাবিতে অনড় সংগঠনগুলো বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এক সংবাদ সম্মেলনে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার কথা জানান। তিনি বলেন, শিগগিরই এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এতে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা সম্মত হয়েছেন।

প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের আগে মজুরি বোর্ডের সংক্ষিপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেগুনবাগিচার বোর্ড কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি শামসুন্নাহার ভূঁইয়া, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি ফজলুল হক মন্টু, মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজী সাইফুদ্দিন ও নিরপেক্ষ প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন।

মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, এর আগে চারটি বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ একমত হতে না পারায় উভয় পক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়। প্রধানমন্ত্রী উভয় পক্ষের কথা শুনে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেন।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম ন্যূনতম মজুরি সাত হাজার টাকা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আট হাজার টাকা করার নির্দেশ দেওয়ার পর আমরা তা মেনে নিয়েছি। ৫১ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি কোনোভাবেই কম নয়।

নতুন এই মজুরি কাঠামোতে সর্বনিম্ন মূল বেতন ধরা হয়েছে চার হাজার ১০০ টাকা, বাড়িভাড়া দুই হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসাভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ৩৫০ টাকা এবং খাদ্যভাতা ৯০০ টাকা।

প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু আরো জানিয়েছেন, আপাতত পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হলো। অন্যান্য শ্রমিকদের বেতন কাঠামো পরে ঘোষণা করা হবে।

এর আগে দেশে এ খাতের শ্রমিকদের জন্য ১৯৮৪ সালে প্রথম মজুরি ঘোষণা করা হয়। ওই সময় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬৩০ টাকা। পরে ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে এক হাজার ৬৬২ টাকা এবং ২০১০ সালে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয় তিন হাজার টাকা। তবে ২০১৩ সালে এসে মূল মজুরি নির্ধারণ করা হয় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা।

পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার পর গতকাল গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ঘোষিত মজুরির মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করা হয়েছে। এই মজুরি কোনোভাবেই বাজারদরের সঙ্গে মিল নেই। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে ১৭ হাজার টাকার বেশি। অথচ রপ্তানি আয়ের বড় খাত পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে আট হাজার টাকা। এ খাতের শ্রমিকদের সঙ্গে এটা প্রতারণা। এই মজুরি প্রত্যাহার করে শ্রমিকদের দাবি ১৬ হাজার টাকা পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘোষিত মজুরি কোনোভাবেই ন্যায্য নয়। এটা তাদের নিশ্চিত জীবন যাপনের জন্য কষ্টকর। সিপিডির প্রস্তাব ছিল ১০ হাজার ২৮ টাকা। অন্তত এখনো এই প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রী বিবেচনায় নিতে পারেন।

শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা করতে হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মজুরি কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছিল। সে হিসেবে আগামী ডিসেম্বরে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বৈঠকে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার ৮৪ শতাংশ আয় করে তৈরি পোশাক খাত। মালিক ও শ্রমিকপক্ষের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু সমাধান দিয়েছেন।

এর আগে রাজধানীর তোপখানা রোডে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বোর্ডের পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেখানে দুই পক্ষই সর্বনিম্ন মজুরি আট হাজার টাকা করার পক্ষে সম্মত হয়। বৈঠক শেষে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম সচিবালয়ে গিয়ে বোর্ডের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জমা দেয়। পরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা দেন।

এর আগে গত ১৬ জুলাই তৃতীয় বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ তাদের প্রস্তাবনা জমা দেয়। ওই বৈঠকে শ্রমিকপক্ষ সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ২০ টাকা করার দাবি জানায়। বিদ্যমান মজুরি ১২৬.৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় তারা। বিপরীতে মালিকপক্ষ ছয় হাজার ৩৬০ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেয়। পরে বোর্ডের চতুর্থ সভায় বোর্ড চেয়ারম্যান দুই পক্ষকেই কিছুটা ছাড় দিয়ে ভারসাম্যের আহ্বান জানান।

এদিকে ন্যূনতম নতুন মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। মজুরি বোর্ডের সভা চলাকালে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন ১৬ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মজুরির দাবিতে তোপখানা রোডে বিক্ষোভ করে। মজুরি ঘোষণার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশ করে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। সমাবেশ থেকে অবিলম্বে ঘোষিত মজুরি পুনর্বিবেচনা করে ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়।

সমাবেশে নেতারা বলেন, বর্তমান বাজারে আট হাজার টাকা দিয়ে কারো পক্ষে জীবন ধারণ করা এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। ঘোষিত মজুরি অগ্রহণযোগ্য। তাঁরা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ঘোষিত হয়েছে। সেখানে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি অর্ধেকেরও কম। শ্রমিকরা এই চরম বৈষম্য কখনো মেনে নেবে না।