বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কত গুরুত্বপূর্ণ?


সৈকত ইসলাম
বাংলাদেশ নিয়ে কয়েকটা কথা বললেও তার মধ্যে একটা হবে এর গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে। বাংলাদেশের রপ্তানি বা বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ গার্মেন্টস সেক্টর ছাড়া চিন্তাও করা যায় না, একইভাবে নারীদের কর্মসংস্থানের কথা আসলেই গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মীদের কথা আসবেই। কিন্তু গার্মেন্টস সেক্টর রপ্তানি, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বা নারী কর্মীদের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? এছাড়াও গার্মেন্টস সেক্টর কি শুধুই রফতানি, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বা নারী কর্মীদের নিয়েই? এর বাইরে অন্যান্য সেক্টরের উপর গার্মেন্টস সেক্টর এর ইতিবাচক প্রভাব কতখানি?

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে সবচেয়ে প্রচারিত তথ্য হল এই খাত আমাদের রপ্তানির আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি। এটি এই খাতের জন্য যতটা ইতিবাচক তথ্য একটি দেশের জন্যই ঠিক ততটা ইতিবাচক তথ্য না। বরং কিছুটা হলেও নেতিবাচক। এটি পরিষ্কার হবে যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী বা সামান্য এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকা কিছু রাষ্ট্রের রফতানি তথ্য দেখা যায়।

ইউএন কমট্রেডের তথ্য মতে ২০১৮ সালে; মিয়ানমারের মোট রফতানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল গার্মেন্টস ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, জ্বালানি ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ , সবজি ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। থাইল্যান্ডের মোট রফতানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল মেশিন ও ইলেকট্রনিক্স ৩০ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ভেহিকেল ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ, প্লাস্টিক এবং রাবার ১২ শতাংশ ০৭ শতাংশ, ফিলিপিনসের মোট রফতানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল- মেশিন অ্যান্ড ইলেক্ট্রোনিক্স ৬৩ শতাংশ, ভেজিটেবল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, ভেহিকলস ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ইন্ডিয়ার মোট রপ্তানি আয়ের প্রধান তিনটি পণ্য এবং তাদের অবদান হল জ্বালানি ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশ, কেমিক্যালস ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মূল্যবান পাথর ও গ্লাস ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলস ৮৭ শতাংশ, ফুটওয়্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ, এর মধ্যে শুধু গার্মেন্টস পণ্যের হিসেবে এই অংশ ৮৪ শতাংশ এর বেশি। অর্থাৎ অন্যান্য দেশের মোট রপ্তানি আয়ে তাদের প্রধান তিনটি রপ্তানি পণ্যের মিলিত অবদানও বাংলাশের মোট রফতানি আয়ে তার প্রধানতম পণ্যটির অবদানের ধারেকাছেও নেই। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাংলাদেশে প্রধান রফতানি পণ্যের তালিকার অন্য কোন পণ্যের অবদান ৫ শতাংশও নয়! এই তথ্যগুলো এটাই নির্দেশ করে যে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রায় সম্পূর্ণটাই আসে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে। শিল্পজাত পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে একটি পণ্যর উপর এত নির্ভরশীলতা অন্য কোন দেশেরই নেই।

গত দুই বা তিন দশকে বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়ার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে, এর মধ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে অন্যতম নিয়ামক। ২০১৬/১৭ এর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য মতে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তি মোট ৬ কোটি ৮ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে নিয়োজিত আছে ১ কোটি ২৪ লাখ ২৪ হাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে ঐ সময়ে গার্মেন্টস সেক্টরে নিয়োজিত ছিল ৪০ লক্ষ মানুষ অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির প্রায় ৩৩ শতাংশ নিয়োজিত আছে গার্মেন্টস সেক্টরে!

নারী কর্মীদের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? বিবিএসের তথ্য মতে, (২০১৬) মোট গার্মেন্টস কর্মীদের প্রায় ৫৪ শতাংশ হল নারী অর্থাৎ ৪০ লাখের মধ্যে কম বেশি ২২ লাখ কর্মী নারী। এই তথ্যটির গুরুত্ব বেড়ে যায় যখন দেখা যায় ২০১৬/১৭ এর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য মতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর সংখ্যা হল ৩১ লাখ ৪৫ হাজার। অর্থাৎ গার্মেন্টস সেক্টরে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ শতাংশ।

বাংলাদেশের শিল্প খাতের নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা কৃষি এবং সেবা খাতের তুলনায় বেশ কম। কিন্তু দেশের জিডিপিতে অবদানের কথা বিবেচনা করলে তাদের মাথাপিচু অবাদান কৃষি এবং সেবা খাতের তুলনায় বেশি। কৃষিতে নিয়োজিত দেশের ৪১ শতাংশ শ্রমশক্তির মোট জিডিপিতে অবদান ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। সেবাখাতে নিয়োজিত দেশের ৩৯ শতাংশ শ্রমশক্তির মোট জিডিপিতে অবদান ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ আর শিল্পখাতে নিয়োজিত দেশের মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমশক্তির মোট জিডিপিতে অবদান ৩৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী মোট জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আয়ের অবদান ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ (এই খাতের আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে)। বৈদেশিক মুদ্রা বা দেশের উন্নয়নের কথা আসলে গার্মেন্টস সেক্টরের সাথে যে খাতটির কথা আসে সেটি হল রেমিটেন্স। তুলনা হিসেবে নয় তবে প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে বলা যেতে পারে, যে বছরের দেশের মোট জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আয়ের অবদান ছিল ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ (এই খাতের আমদানি ব্যয় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে) সেই বছরে রেমিটেন্সের অবদান ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

গত তিন দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে আসলে অনেকগুলো বিষয় আসতে পারে, তবে নিশ্চিত ভাবে জিডিপি গ্রোথ সবচেয়ে বেশি হাইলাইট হয়ে থাকে, সেই সাথে মাথাপিচু আয়। এই জিডিপি গ্রোথে যদি গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান বিবেচনা করা যায়? ২০১৮ সালে জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান ছিল ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ, এর আগের দশকগুলোতে অবস্থা কি ছিল? ১৯৯১ সালে জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান ছিল ২ দশমিক ৮০ শতাংশ আর ২০০০ সালে ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (এই খাতের আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে)। একই সময় যদি মাথাপিচু আয়ের হিসেব দেখা যায়? ১৯৯১ সালে মাথাপিচু জিডিপি ছিল ২৯৩ মার্কিন ডলার, ২০০০ সালে ছিল ৪১৮ মার্কিন ডলার যেটা ২০১৮ সালে হয়েছে ১৬৯৮ মার্কিন ডলার । একই সময়ের মধ্যে লেবার প্রোডাক্টিভিটি প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে ১২৫৫ থেকে ২৫৫০ মার্কিন ডলার।

এই উন্নয়েনের পিছনে শিল্প, কৃষি, সেবা সব খাতের অবদানই রয়েছে কিন্তু শিল্প খাত কিছুটা বেশি গুরুত্ব দাবী করতেই পারে। কেননা এই সময়ে (১৯৯০-২০১৮) দেশের জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান প্রায় একই থেকে গেছে ৪৯ দশমিক ৭৩শতাংশ থেকে ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ কৃষি খাতের অবদান অনেক কমে গেছে ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ কিন্তু শিল্পখাতের অবদান বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে ২১ দশমিক ০৪ শতাংশ থেকে ৩৩ দশমিক ৬৪ । আর দেশের শিল্প খাতে যে গার্মেন্টস সেক্টর কতখানি গুরুত্বপুর্ন সেটা আগের প্যারাতেই এসেছে।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে যদি একটা সারাংশ করা যায় তাহলে সবচেয়ে প্রচলিত যে তথ্যগুলো আসবে তা হল; গার্মেন্টস সেক্টর মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ যেখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগী বা সামান্য এগিয়ে/পিছিয়ে থাকা কিছু রাষ্ট্রের মোট রপ্তানি আয়ে তাদের প্রধান তিনটি রপ্তানি পণ্যের মিলিত অবদানও বাংলাশের প্রধানতম পন্যটির মোট রপ্তানি আয়ের ধার কাছেও নেই। এটি দেশের মোট জিডিপির ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ । মোট শিল্পখাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৩৩ শতাংশ এই খাতে নিয়োজিত, শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারী শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশ এই খাতে কাজ করে। ১৯৯০ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে দেশের মাথাপিচু জিডিপি বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ একই সময়ে জিডিপিতে গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান বেড়েছে প্রায় ৫ গুন (এই খাতের আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে শুধু রপ্তানি আয়ের হিসাবে)।

শুধু এই পরিসংখানগত তথ্য বিবেচনা করলে মনে হয়ে বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর আসলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যদিও এর বাইরেও অনেক পরিসংখ্যান আছে, যা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, যেমন এই রফতানি আয়ের কত টাকা এই খাতের কাঁচামাল বা মেশিনারি আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে, সরকার এই খাতে কত সহায়তা দিচ্ছে, কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়ন কেমন হচ্ছে। এছাড়াও একটি সেক্টর দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা পরিমাপের জন্য অন্যান্য সেক্টরে ওই সেক্টরের স্পিলওভার ইফেক্টও একটা বিষয়। গার্মেন্টস সেক্টর সেটা কতখানি রাখতে পেরেছে সেটাও বিবেচনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের যে অংশ অবস্থিত তাতে বাংলাদেশ মূলত এই খাতের ম্যানুফ্যকচারিং এর সাথে জড়িত, এই পণ্যগুলোর ডিজাইন এবং মার্কেটিং এর কাজটি সাধারণত পশ্চিমা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা তাদের প্রতিনিধি কোন প্রতিষ্ঠান করে থাকে। যদিও গত দেড় দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর শুধু তাদের পণ্য বিক্রির পরিমান বৃদ্ধি করে নি বরং তাদের পণ্যের বৈচিত্রতা থেকে শুরু করে প্রোডাকশান আপগ্রেডিং এর মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক করেছে। এই ধারাবাহিকতায় উৎপাদনের সাথে জড়িত অনেক কাঁচামাল দেশে উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তারপরেও এই খাতের কাঁচামাল বা মেশিনারি আমদানি করতে বেশ বড় অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যদি রফতানি আয়ের কত অংশ এই খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যায় হচ্ছে সেই হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে এই খাত থেকে দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে। সেটির পরিমান কত? বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য মতে ২০১৮ সালের গার্মেন্টস সেক্টরের মোট রপ্তানি আয়ের ৩৯ দশমিক ০৬ শতাংশ ব্যায় হয়েছে এই খাতের কাঁচামাল এবং মেশিনারি আমদানিতে। টাকার অংকে যেটি ১১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন! ওই বছরে রপ্তানি ছিল ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন। অর্থাৎ আমাদানি ব্যায় বাদ দিলে এই খাত থেকে দেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার আয় ছিল ১৮ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন। ওই বছরেই রেমিটেন্স খাতে আয় ছিল ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন। এই হিসেবে জিডিপিতে ওই বছরের গার্মেন্টস সেক্টরের অবদান আসে ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ যেটি এই আমদানি ব্যায় বাদ না দিয়ে হিসাব করা হলে হয় ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। এটি শুধু একবছরের চিত্র নয় বরং কোন বছরেই গার্মেন্টস খাতের আমদানি ব্যায় মোট রপ্তানি আয়ের ৩৫ শতাংশ এর নিচে নয়। অর্থাৎ রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয়ের কথা বলা হয়ে থাকে সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায়ের হিসাবটাও করা প্রয়োজন। তুলনা হিসেবে নয় তবে প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে বলা যেতে পারে ২০১৩ সালেও গার্মেন্টস খাতের আমদানি ব্যায় বাবদ যে পরিমান বৈদিশিক মুদ্রা ব্যায় হয়েছে তা বাদ দিলে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা রেমিটেন্সের থেকে কম ছিল।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিষয়টি ছাড়া গার্মেন্টস সেক্টরের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল শিল্প ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি। গার্মেন্টস সেক্টরে নারী কর্মীদের স্বল্প মজুরি বিবেচনায় নিয়েও বলা যায় এই কর্মসংস্থান তাদের দারিদ্র্য হ্রাসে এবং ক্ষমতায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে যা বিভিন্ন গবেষনায় এসেছে। কিন্তু নারী কর্মীদের দারিদ্র্য হ্রাসে এবং ক্ষমতায়নে গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে গবেষণায় একটি বিষয় প্রায় অনুপস্থিত থেকে গেছে। এই খাতে কর্মরত নারী কর্মীদের বয়স ২০ থেকে ৪০ এর মধ্যে । ৪০ এর অধিক বয়সের নারী কর্মী নেই বললেই চলে। এই নারী কর্মীরা সহনীয় মাত্রার দারিদ্র্য সীমা অতিক্রম করার জন্য যে মজুরি প্রয়োজন তাঁর চেয়ে সামান্য কিছু বেশি মজুরিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মত বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্য্যবহুল জায়াগাগুলোতে দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘন্টা করে ১৫ থেকে ২০ বছর কাজ করে। এরপর যখন তাঁদের জীবিকার এই খাতটি ছাড়তে হয় তারপর তাঁদের জীবনধারনের কি উপায় হয়? এই খাত তাঁদের জীবনের পরবর্তী ৩০-৩২ বছর (গড় আয়ু হিসেবে) এ কি ইতিবাচক কোন পরিবর্তন আনবে কি না সে বিষয়ে কোন গবেষণা নেই বললেই চলে। এই বিষয়ে তথ্য ছাড়া এই খাত তাঁদের কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়ন করছে বা দারিদ্য হ্রাস করছে তা নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন।

একটি সেক্টর দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা পরিমাপের জন্য অন্যান্য সেক্টরে ওই সেক্টরের স্পিলওভার ইফেক্ট গুরুত্বপূর্ণ। গার্মেন্টস সেক্টরের অগ্রগতি বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের জন্য যথেস্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে স্পিনিং, ডাইয়িং শিল্প সহ গার্মেন্টস সেক্টরের বিভিন্ন কাঁচামাল ও খুচড়া যন্ত্রাংশের শিল্প পুরোপুরি গার্মেন্টস সেক্টরের প্রবৃদ্ধির সাথে বিকাশ লাভ করেছে। গার্মেন্ট সেক্টরের সাথে গড়ে উঠা সংযুক্ত শিল্পগুলো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অত্যান্ত ইতিবাচক ছিল।

এছাড়াও বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ব্যাংক ও বীমার মত খাত ও সেবা খাতের পরিবহন, হোটেল, ইত্যাদিও গার্মেন্টস সেক্টরের প্রবৃদ্ধির সাথে উল্লেখযোগ্য হারে প্রসার লাভ করছে। বলা হয়ে থাকে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের শ্রমনিবিড় শিল্পগুলো দেশের অন্যান্য শিল্পের উপর সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন রাখে না কেননা এতে প্রযুক্তি বা পুজি স্থানান্তরের সুযোগ কম। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অন্যন্য খাতে অবদান নেহাত কম নয়।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে নানা ইতিবাচক নেতিবাচক কথা আছে। সাম্প্রতি সেটির মাত্রা দুই তরফেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধ সত্তেও এই খাতটি দেশের প্রধান রপ্তানি খাত। গত ৬ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা এই খাত থেকেই এসেছে। শিল্প খাতে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান এই খাতের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে এমন কি দেশের সেবা খাতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও এই খাতের অবদান অনেক। তারপরেও বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কত গুরুত্বপূর্ণ সেটার উত্তর শুধু কিছু পরিসংখ্যান বা অন্য কোন খাতের সাথে তুলনার মাধ্যমে দেয়া যৌক্তিক হবে না। এই খাতের সীমাবদ্ধতা গুলোর সমাধান চাইলে এর সমালোচনার চেয়ে জরুরি এর বিকল্প তৈরি করা। কেননা বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টর কত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের একটি উত্তর হল বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্টস সেক্টরের বিকল্প এখনো নেই।