প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯
ড. মইনুল ইসলাম
জিডিপির কনসেপ্ট সম্পর্কে যাদের ভালো জানা নেই, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, পাঁচটি কম্পোনেন্টের ভিত্তিতে একটি দেশের জিডিপি বা গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট পরিমাপ করা হয় :এক বছরে মোট অভ্যন্তরীণ ভোগ, প্রাইভেট খাতের বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয় (পৌনঃপুনিক ব্যয় এবং উন্নয়ন ব্যয়) এবং রফতানি আয়ের যোগফল থেকে আমদানি ব্যয় বিয়োগ করলে জিডিপি পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক উন্নয়নশীল দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হলেও এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানপ্রত্যাশী নারী-পুরুষদের জন্য যথাযথ সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। এই সমস্যাকে উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ নামে অভিহিত করা হয়। আসলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি যদি প্রধানত ভোগ, সরকারি ব্যয় ও রফতানিচালিত হয় এবং বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত যদি যথেষ্ট গতিতে না বাড়ে, তাহলে এই ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ দেখা দিতে পারে। আবার প্রায় সব আধুনিক প্রযুক্তি যেহেতু উন্নত পুঁজিবাদী দেশে উদ্ভাবিত হচ্ছে, সে জন্য এই নতুন নতুন প্রযুক্তি স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিঘন এবং শ্রম-সাশ্রয়ী হয়ে থাকে। এ কারণেও উন্নয়নশীল দেশগুলো ওই শ্রম-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি আমদানি করে ব্যাপকভাবে উৎপাদনে প্রয়োগ করলে ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ গুরুতর সমস্যা হিসেবে উদ্ভূত হয়।
দৈনিক প্রথম আলোর ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখের পেছনের পৃষ্ঠার হেডলাইন- ‘গার্মেন্টসে নারী শ্রমিক কমছে’। এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার মূল কারণ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। এখানেই বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের একটা বড় বিপদের ‘অশনিসংকেত’ পাওয়া যাচ্ছে। আজকের কলামটা এই বিষয়েই। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিকাশের প্রাথমিক পর্বে, মানে বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিলেন নারী। ওই ফ্যাক্টরিগুলোর সিংহভাগই ছিল ‘কাটিং অ্যান্ড মেকিং’, মানে সেলাইনির্ভর ওভেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি; নারী শ্রমিকরা যে কাজগুলোতে পুরুষদের চেয়ে বেশি পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হতেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিচারে নারী শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ছিল বেশি; কিন্তু মজুরি ছিল কম। এই দুটি বৈশিষ্ট্য থাকলেই শ্রমকে ‘সস্তা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত করা যায়। ওই পর্যায়ে নারী শ্রমিকদের নিয়মিতভাবে অনেক বেশি সময় খাটিয়ে নেওয়া হতো; কিন্তু নব্বই দশক থেকে নিটওয়্যার শিল্প দ্রুত বিকশিত হওয়ার পর নিটওয়্যার ফ্যাক্টরিগুলোতে পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নারীদের চেয়ে দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করে। ফলে যুক্তভাবে ওভেন এবং নিটওয়্যার এ দুই ধরনের তৈরি পোশাক শিল্পের মোট শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকের অনুপাত কমতে শুরু করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের এক জরিপ দেখাচ্ছে, ওই বছর পোশাক খাতে কর্মরত মোট ২৯ লাখ ৯৭ হাজার শ্রমিকের মধ্যে নারী ছিলেন ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আর পুরুষ ছিলেন ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যাচ্ছে, মোট ৩৩ লাখ ১৫ হাজার গার্মেন্ট শ্রমিকের মধ্যে পুরুষের অনুপাত ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং নারীর অনুপাত কমে ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। আরও লক্ষণীয়, পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের মোট সংখ্যাও ২০১৩ সালের ১৭ লাখ ৪ হাজারের তুলনায় ২০১৮ সালে ১৫ লাখ ৩১ হাজারে নেমে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে বিজিএমইএ দাবি করে আসছিল।
নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বলা হচ্ছে, গত এক দশক ধরে পোশাক শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। এসব যন্ত্র একই সঙ্গে অনেক কাজ করতে পারে। তাই আগে যেসব কাজ নারী শ্রমিকরা করতেন, সেগুলো এখন যন্ত্রের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। এখন সুইয়িং, ফিনিশিং, কাটিং, এমব্রয়ডারি, নিটিং ও ওয়াশিং- মূলত এই ছয় ধরনের কাজ হয় বাংলাদেশে। নারীরা এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেন সুইয়িংয়ে। এর পর ফিনিশিং। অন্য কাজগুলোতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ তেমন নেই। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই নতুন কাজগুলোতে দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারে নারী শ্রমিকরা নাকি তেমন আগ্রহ দেখান না। বরং পুরুষ শ্রমিকরা নতুন প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা অর্জনে প্রশিক্ষণে প্রবল আগ্রহী। আর নারী শ্রমিকরা গড়ে শ্রমিক হিসেবে নাকি কাজ করেন সাত বছর। তারপর তারা সাংসারিক দায়িত্বে জড়িয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থাপনায়ও পোশাক খাতের মালিকরা নারীদের নিয়োগ দেন না মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। দক্ষ ও শিক্ষিত নারী ব্যবস্থাপকও পোশাক খাতে তেমন আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। অন্যদিকে, এখন পোশাক শিল্পের মজুরি খানিকটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরুষ শ্রমিকরাও এ খাতে কাজ পেতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
বিষয়টি নিয়ে গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ, এ দেশের শিল্পায়নে তৈরি পোশাক খাতকে একটি বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি এ খাতে ব্যাপক সংখ্যক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানকে একটি ‘বৈপ্লবিক অর্জন’ আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই প্রথমবার প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প শ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে নারীরা বাড়ির বাইরে এসে কর্মে নিয়োজিত হওয়ায় এ ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, তাকে একটা ‘বিপ্লব’ বললে বাগাড়ম্বর হবে কি? সমাজে যেখানে মোল্লাদের ফতোয়াবাজি ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তিশালী হয়ে চলেছে, সেখানে স্র্রোতের বিপরীতে নারী সমাজের ক্ষমতায়নে পোশাক শিল্পে নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থান আশি ও নব্বই দশকে একটা ‘বিপ্লব’ই ছিল!
প্রশ্ন হলো, আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তারের ফলে ক্রমেই কৃষি, শিল্প এবং সেবা ও বাণিজ্য খাতের সব উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রমিকের আনুপাতিক প্রয়োজন দিন দিন সংকুচিত হওয়ার যে প্রবণতা বিশ্বে শক্তিশালী হয়ে চলেছে, তাকে মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? বাংলাদেশের মতো যেসব জনবহুল দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান, সেখানেই ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার ফলে দেশগুলোতে জিডিপি বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকার সমস্যা যতখানি কমে আসার কথা, ততখানি কমানো যাচ্ছে না। অনেক উন্নয়নতাত্ত্বিক এ সমস্যাকে ‘ক্রমহ্রাসমান এমপ্লয়মেন্ট ইলাসটিসিটি’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান যে দুরূহ, সেটাও ক্রমে উন্নয়নচিন্তকদের লেখায় ফুটে উঠছে। চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটা প্রধান ডাইমেনশন হিসেবে উন্নত দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সে’র উদ্ভাবনকে যেভাবে অগ্রাধিকারে পরিণত করা হয়েছে, তার ফলে শ্রমঘন প্রযুক্তিকে পিছু হটিয়ে ক্রমেই যন্ত্র ও রোবটিক্সনির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকবে। অতএব, প্রযুক্তি বিকাশের চারিত্র্যের কারণে বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশের জন্য কর্মসংস্থান ইস্যুটা ভবিষ্যতে আরও জটিল হয়ে পড়বে। এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে দেশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত আধুনিকায়নের পথেই এগোতে হবে।
আমাদের সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের শিক্ষাবঞ্চিত নারীরা পোশাক শিল্পে তাদের সহজাত দক্ষতা অর্জন ক্ষমতার সহায়তায় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ পোশাক শিল্পে সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞাননির্ভর আধুনিক মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় নারী শ্রমিকরা দক্ষ টেকনিশিয়ান হয়ে উঠতে পারেননি। তারা কম্পিউটার চালাতে পারছেন না; কম্পিউটারচালিত যন্ত্রপাতিও চালাতে অপারগ। অতএব তারা ছিটকে পড়ছেন জটিল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী কাজগুলো থেকে। এমনকি আমাদের পোশাক শিল্পে যে দুই লাখের মতো দক্ষ বিদেশি টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপক লোভনীয় বেতনে কর্মরত, সে চাকরিগুলোতে আমাদের দেশের দক্ষ টেকনিশিয়ান-প্রফেশনাল পাওয়া যাচ্ছে না বলে গার্মেন্টস মালিকরা অভিযোগ করে চলেছেন। ভারত, শ্রীলংকা, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন থেকে এ ধরনের দক্ষ টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপক জোগাড় করতে তারা নাকি বাধ্য হচ্ছেন!
শুধু পোশাক শিল্পেই নয়; ‘জবলেস গ্রোথ’ পুরো অর্থনীতিতেই সমস্যা হিসেবে গেড়ে বসেছে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ লাখ কর্মসংস্থ্থানপ্রত্যাশী মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্য থেকে ৬-৭ লাখ মানুষের যেনতেনভাবে বিদেশে অভিবাসন অব্যাহত থাকায় একটা ‘সেফটি ভাল্ক্ব’ হিসেবে এই প্রবাহ বেকার সমস্যাকে আড়াল করে চলেছে। আদম ব্যাপারীদের লাখ লাখ টাকার খাঁই মিটিয়ে দেশের যে অভিবাসনেচ্ছু তরুণরা বিশ্বের পথে-প্রান্তরে প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা সাগর-মহাসাগরে ডুবে মরছে, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে ক্ষমতাসীনরা যতই কটাক্ষ করুন, এই বিদেশে পালাতে মরিয়া তরুণরা শুধুই শিক্ষিত বেকারদের মধ্য থেকে আসছেন না; এটা দেশের গ্রামীণ-শহুরে নির্বিশেষে অর্ধ-বেকার যুবকদের মরণপণ জীবন-জীবিকার সংগ্রামও। অতএব, এই ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণ সময়ের প্রধান দাবি।