এসএম আলমগীর
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম
কথা ছিল ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে সব গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিককে চলতি মাসের অর্ধেক বেতন ও বোনাস পরিশোধ করা হবে। এ কথা দিয়েছিলেন খোদ গার্মেন্টস মালিক ও তাদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র নেতারা। ২০ জুলাই মালিক, শ্রমিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকে এ প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন তারা। বেঁধে দেওয়া সে সময়ের পর পার হয়ে গেছে আরও দুদিন আগে। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকরা কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। সব শ্রমিককে বেতন-বোনাস দিলেন না।
শিল্প পুলিশ ও শ্রমিক নেতাদের ভাষ্যমতে বুধবার পর্যন্ত মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ কারখানায় বেতন-বোনাস দেওয়া হয়েছে। এখনও ৭০ শতাংশ কারখানাতেই বাকি রয়েছে বেতন-বোনাস দেওয়া। আজকের দিনটি ধরে ঈদের বাকি আছে আর মাত্র দুদিন। এ সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই বাকি অংশের বেতন-বোনাস দেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা। অথচ বেতন-বোনাস দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের বিশেষ তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে।
অন্যদিকে বেতন-বোনাস সময় মতো না দেওয়ায় এবং বেতন-বোনাস না দিয়ে হঠাৎ করেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় প্রতিদিনই শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার মধ্যে এবং আশপাশের এলাকা গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জে এখন প্রতিদিন বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিকদের রাজপথে নামতে হচ্ছে।
অবশ্য বুধবার বিজিএমইএ’র অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রæপে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয় ২৯ জুলাই পর্যন্ত চালু কারখানার মধ্যে ১৬৬৯টি কারখানায় ঈদ বোনাস দেওয়া হয়েছে। শতাংশের হারে যা ৮৮ ভাগ। বোনাস দিতে বাকি আছে এখনও ১২ শতাংশ বা ২২৯টি গার্মেন্টস কারখানায়। তবে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে জুলাই মাসের অর্ধেক বেতনের কোনো তথ্য জানানো হচ্ছে না। বুধবার পর্যন্ত কতগুলো কারখানায় বেতন দেওয়া হয়েছে সে তথ্য তারা লুকাচ্ছে। অবশ্য বিজিএমইএ’র এ তথ্য মানতে নারাজ শ্রমিক নেতারা।
এ বিষয়ে শ্রমিক নেত্রী জলি তালুকদার সময়ের আলোকে বলেন, গত সপ্তাহে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে মালিকরা নিজেরা প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে বেতন-বোনাস দেওয়ার। কিন্তু এখন তারা তাদের প্রতিশ্রিæতই ভঙ্গ করেছেন। এখন আবার মিথ্যাচার করছেÑ বলছে ৮০ ভাগ কারখানায় বোনাস দেওয়া হয়েছে। এটি ডাহা মিথ্যা কথা। আমাদের তথ্য মতে এখন পর্যন্ত ৫০ ভাগ কারখানায় বোনাস দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রায় ৯০ ভাগ কারখানা মালিক জুলাই মাসের অর্ধেক বেতনই দিতে চাচ্ছেন না। সরকারের তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা পাওয়ার পরও শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দেওয়ার বিষয়টি শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের প্রতারণার শামিল।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র বক্তব্য জানতে সংগঠনটির সভাপতি রুবানা হক এবং বেশ কয়েকজন সহসভাপতির মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি। অবশ্য বিজিএমইএ এখন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রæপেই তাদের মতামত ও বিবৃতি দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।
শিল্প পুলিশের তথ্য বলছে, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ’র সদস্যভুক্ত ৩ হাজার ৩৭২টি কারখানার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৬১টি কারখানায় বোনাস দেওয়া হয়েছে। এখনও বোনাস দেওয়া হয়নি ২ হাজার ৭১১টি কারখানায়। এ ছাড়া পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন খাতের ৭ হাজার ৬০২টি কারখানার মধ্যে বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৮ টির। এখনও বোনাস পরিশোধ করা হয়নি ৬ হাজার ১৪টি কারখানায়।
শিল্প পুলিশের ২৮ জুলাইয়ের তথ্য মতে, পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন খাতের ৭ হাজার ৬০২টি কারখানার মধ্যে বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৮টির। এখনও বোনাস পরিশোধ করা হয়নি ৬ হাজার ১৪টি কারখানায়। বিজিএমইএ’র ১ হাজার ৮৮২টি কারখানার মধ্যে বোনাস পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৪৪৩টির। বোনাস পরিশোধ করা হয়নি এমন কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৪৩৯টি। বিকেএমইএ’র ১ হাজার ১০১টি কারখানার মধ্যে বোনাস পরিশোধ করেছে ১৩৪টি। আর এখনও বোনাস দেয়নি ৯৬৭টি কারখানা। বিটিএমএ’র ৩৮৯টি কারখানার মধ্যে ৮৪টি কারখানায় বোনাস হয়েছে। এখনও বোনাস হয়নি ৩০৫টি কারখানার। বেপজার অভ্যন্তরের কারখানা ও অন্যান্য খাতের কারখানাগুলোর অবস্থা একই।
বিকেএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বুধবার সময়ের আলোকে এ বিষয়ে বলেন, বিকেএমইএ’র সাড়ে ৮শ কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়া চলছে। তবে কতগুলোতে এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। কারখানা মালিকরা তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যে যার মতো করে বোনাস দিচ্ছে। কে কত টাকা বোনাস দিচ্ছে সেটিও বলা মুশকিল। জুলাই মাসের অর্ধেক বেতন কোনো কোনো মালিক দিয়েছে। অধিকাংশই দিতে পারেনি। সামনে যে কয়েকদিন আছেÑ আশা করি তার মধ্যে দেওয়া হয়ে যাবে। তবে এখন পর্যন্ত বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত কারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে কোনো শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়নি। কারণ আমরা শ্রমিকদের বোঝাচ্ছি চলমান করোনা সঙ্কটের বিষয়টি এবং শ্রমিকরাও মালিকদের সমস্যা বুঝছে।
আরেক শ্রমিক নেতা ও ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, বেতন-বোনাস নিয়ে এখন প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। এখনও অনেক কারখানায় বেতন-বোনাস দেওয়া বাকি রয়েছে। আবার অনেক কারখানা মালিক ঈদের আগ দিয়ে বেতন-বোনাস না দিয়ে কোনোরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বরে জয়েন্ট টেক্স নিটওয়্যার লিমিটেডের কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন রাত অবধি কারখানাটির চার শতাধিক শ্রমিক বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে রাখে। পরে বুধবারও মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে দিনভর সড়ক অবরোধ করে রাখে শ্রমিকরা। এভাবে গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বেতন-বোনাসের দাবিতে প্রতিদিনই শ্রমিকরা রাজপথে নামতে বাধ্য হচ্ছে। মালিকরা কথা দিয়েও কথা না রাখায় কয়েক লাখ শ্রমিককে বেতন-বোনাস ছাড়াই এবার ঈদ কাটাতে হবে।