এম সায়েম টিপু ২৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০
মিরপুর-১২ নম্বর এলাকার মুসলিমবাজার মোড়ে গত সোমবার বিকেলে বেশ কয়েকজন শ্রমিক হৈচৈ করছিলেন। তাঁরা সেখানকার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। ওই দিনই কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আব্দুর রহমান, সেলিমা বেগম, সুমি আক্তার ও রুপালী বেগম—যাঁরা জয়েনটেক্স নিটওয়্যার নামের কারখানাটিতে চাকরি করতেন। তাঁরা বেকার হয়ে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মুখ মলিন। রাগে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেনও। তাঁরা কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদককে বলেন, আগের দিনও তাঁদের দিয়ে সারা রাত কাজ করিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরের দিনই তাঁদের ‘রাস্তায় ছুড়ে’ দিয়েছে। তাঁদের কোনো আইনি সুবিধাও দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ নোটিশ না দিয়েই কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে আব্দুর রহমান বলেন, ‘মানুষ এত অমানবিক হয়; পোশাক কারখানার মালিকদের না দেখলে বোঝা যাবে না। ওদের মুখে মধু অন্তরে বিষ।’ সেলিমা বেগম বলছিলেন, ‘হেরা আমাগো কথা কইয়া সরকার থেকে লাখ লাখ টাকার সুবিধা নেয়।’
করোনাভাইরাস মহামারির এই দুঃসময়ে চাকরি হারিয়ে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকল না এসব শ্রমিকের। অথচ করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এই শ্রমিকদের প্রতি মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল।
পোশাক খাত সূত্রে জানা গেছে, ২৫ মার্চ সরকার পোশাক খাতসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করে। এরপর ৫ এপ্রিল সরকার একই খাতের চলতি মূলধনের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। ওই সময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য দেওয়া হয় ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা। শ্রমিকদের জুন মাসের মজুরি দিতে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা আড়াই হাজার কোটি টাকা পেয়েছেন জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। চলতি মাসের মজুরি দিতে গত বৃহস্পতিবার আরো তিন হাজার কোটি টাকা পেয়েছেন। এসব প্রণোদনা স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ হিসেবে নিতে পারছেন তাঁরা। এ ছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ১৫০ কোটি ডলার বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার করা হয়েছে, যেখান থেকে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ২ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারেন। পোশাক রপ্তানির ওপর ১ শতাংশ নগদ সহায়তা এবং নতুন বাজারে রপ্তানির জন্য ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা তো আছেই।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন লে অফ কারখানার জন্য ৩০ কোটি ইউরোর একটি তহবিল গঠন করেছে, যেখান ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো যাবে শ্রমিকদের মজুরি বাবদ। এ তহবিলের ব্যাপারে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
এ ছাড়া পোশাক খাতের দুঃসময়ও আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। এই সব কিছুর পরও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা মানবিক হতে পারছেন না বলে মনে করেন শ্রমিকরা। তাঁরা বলছেন, ছাঁটাই ছাড়াও নিয়মিতই বন্ধ হচ্ছে শত শত কারখানা। আর বেকার হচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক। কিন্তু শ্রম আইন মেনে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশের (আইবিসি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন নতুন পদ্ধতিতে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। রাজধানীর মিরপুরে জয়েনটেক্স নামের যে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেখানে ৩৫০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। তাঁদের ঈদ উৎসব ভাতা ও জুলাইয়ের মজুরি দিলেও আইনি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরের শেষ মাস জুনে করোনাকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এসেছে। বিদেশি ক্রেতারা যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছিলেন সেগুলোও আবার নিতে শুরু করেছেন।
উদ্যোক্তারা জানান, করোনার ধাক্কায় পোশাক খাতের প্রায় ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়। কিন্তু এখন এসব পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ ক্রেতা ফিরে এসেছে। সম্প্রতি নতুন ক্রয়াদেশও আসছে।
বিজিএমইএর একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, তৈরি পোশাক খাত এরই মধ্যে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। তবে এখনো শতভাগ সক্ষমতা নিয়ে কাজ শুরু করার সময় হয়নি। তিনি বলেন, গত জুন মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়লেও পুরোপুরি ইতিবাচক ধারায় ফিরতে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নতুন ক্রয়াদেশের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১৮ দিনে ১৫৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ এসেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১.৭৪ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে ক্রয়াদেশ এসেছিল ১৭৯ কোটি ডলারের।
ক্লাসিক ফ্যাশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইর সাবেক সহসভাপতি শহিদুল আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে সরকারি ছুটির দিনগুলো ছাড়া অন্য সময় তাঁর কারখানা চালু ছিল। এ সময় আগের কাজের পাশাপাশি তিনি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) তৈরি করেছেন।
আজিম বলেন, এখন ক্রেতারা তাঁদের বাতিল ও স্থগিত করা পণ্য নিতে শুরু করেছেন। এ জন্য বিক্রয়ের ওপর বড় ছাড় দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য পাঠাতে হচ্ছে আকাশপথে। তিনি জানিয়েছেন, নতুন কাজ আসতে শুরু করেছে। পুরো জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এটা চলবে। তবে বেশির ভাগ ক্রেতাই দর কমিয়ে দিচ্ছেন। এক ডজন টি-শার্টে পাঁচ-ছয় ডলার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগে পণ্য সরবরাহের পরপরই দাম পরিশোধ করা হতো। এখন ৯০ থেকে ১৮০ দিন দেরিতে পরিশোধ করছে।
বিকেএমইএ নেতা মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার পোশাক খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রণোদনাসহ আন্তরিক সহযোগিতা দিলেও পোশাক খাত করোনার কারণে যে বেড়াজালে পড়েছে সেখান থেকে বের হতে পারছে না। কেননা সরকারের সহযোগিতা নানা শর্তজালে আবদ্ধ। ব্যাংকগুলো সহজে উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার টাকা ছাড়া করতে চায় না।
করোনাকালে শ্রমিকদের কাজ হারানো নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু এপ্রিল-মে মাসে দেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় সংগঠন বিজিএমইএ সদস্য এমন ৩৪৮টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করতেন তিন লাখ ২৪ হাজার ৬৮৪ জন শ্রমিক। এ ছাড়া সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) হিসাব অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর এক হাজার ৯১৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই বর্তমানে বেকার।
সূত্র জানিয়েছে, এর বাইরেও গত কয়েক মাসে ৮৭টি কারখানা থেকে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গার্মেন্ট কারখানার সংখ্যা ৭৫টি। অন্যদিকে বন্ধ হওয়া কারখানার তালিকায় লে অফ (সাময়িক বন্ধ ঘোষণা) হওয়া কারখানা রয়েছে ৩৭টি। এসব কারণে শ্রম অসন্তোষও চলছে দেশের বিভিন্ন কারখানায়। ডিআইএফইর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় ৬৫টি কারখানায় শ্রম অসন্তোষ চলছে। এর মধ্যে ৫৫টি গার্মেন্ট কারখানা।
শ্রমিক নেতারা বলেন, তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে ৪০ লাখের বেশ শ্রমিক জড়িত। এর প্রায় ৮০ শতাংশ দেশের গ্রামীণ জনপদ থেকে উঠে আসা সাধারণ নারী শ্রমিক।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শ্রমিকদের জন্য মানবিক হতে সরকার পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। যেনতেনভাবে কারখানা বন্ধ করলেই হবে না; এর একটা নিয়ম আছে। এসব নিয়ম যেন সতর্কতার সঙ্গে মানা হয়।’
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে চাহিদা ও সরবরাহ খাতে সমস্যা ছিল। এখন আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে মন্দাভাব থাকলেও আমাদের সরবরাহ সক্ষমতা ভালো। এপ্রিল-মে মাসে চাহিদার ক্ষেত্রে যে মন্দাভাব ছিল এখন আর সেটা নেই।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি শ্রমিক ছাঁটাই কিছুটা কম হলেও বাড়ছে মধ্যম সারির কর্মীদের ছাঁটাই। এ ছাড়া স্থানীয় বায়িং হাউসের অনেক কর্মীও এরই মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। তিনি বলেন, বেশির ভাগ কারখানায় আগেও কাজ ছিল; এখনো অনেক কাজ আছে। কোনো কোনো কারখানায় শ্রমিকদের অতিরিক্ত (ওভার টাইম) কাজ করানো হচ্ছে।